প্রকাশ: ৬ জুন, ২০২২ ১২:০৬ : পূর্বাহ্ণ
বেলায়েত বাবলু : তথ্যমতে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি বছর চার হাজার ৭২০ জন গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৩ জন অর্থাৎ প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হয়। সন্তানের জন্য মায়ের এ আত্মত্যাগ কখনো অস্বীকার করার উপায় নেই। আসলে গর্ভে ধারণ থেকে শুরু করে সন্তানের বেড়ে ওঠা, সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করা সকল ক্ষেত্রেই মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। এক কথায় মায়ের সাথে কারো তুলনা করা চলেনা। লেখার প্রসঙ্গ মা নিয়ে হলেও বরিশাল জেলার দুই উপজেলায় সাম্প্রতিককালে দুই শিশুর সাথে ঘটে যাওয়া বর্বর দুটি ঘটনা আমাদের মমতাময়ী, জনমদুঃখী মায়েদের অপমানিত করেছে।
বরিশালের উজিরপুরের হারতা ও সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের ছোট রাজাপুর গ্রামে দুই মায়ের অনৈতিক কর্মকান্ড দেখে ফেলার কারণে দুই শিশু বলি হয়েছে। গনমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বরিশালের উজিরপুরের হারতা এলাকায় পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে মায়ের অনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে ফেলায় শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র দীপ্ত মণ্ডলকে (৮)। হত্যার পর শিশুটিকে দুই দিন ফেলে রাখা হয় সেলুনে বসার জন্য তৈরি কাঠের সিটের ভেতর।মরদেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হলে শুক্রবার (২৯ মে) মৃতদেহ বস্তায় ভরে ডোবায় ফেলে দেন শিশুটির মা সীমা মণ্ডল ও তার পরকীয়া প্রেমিক নয়ন শীল এবং তাদের সহযোগী সেলুন মালিক দম্পতি রতন বিশ্বাস ও ইভা বিশ্বাস।গত রোববার ভোরে ডোবা থেকে তার বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত শিশুর মা সীমা মন্ডলসহ গ্রেফতার ৪ আসামি বুধবার (০১ জুন) সন্ধ্যায় বরিশাল আদালতে হত্যার ঘটনায় স্বীকোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।দীপ্ত মণ্ডল ওই উপজেলার হারতা ইউনিয়নের কাজী বাড়ির দীপক মণ্ডলের ছেলে।
দুই ভাইয়ের মধ্যে সে বড়।উজিরপুর থানার ওসি আলী আর্শাদ জানান, গত ২৭ মে রাতে ১১টার দিকে দীপ্তর মা সীমা মণ্ডল তার পরকীয়া প্রেমিক নয়ন শীলের সঙ্গে সেলুনের শার্টার আটকে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হন। দীপ্ত তার মাকে খুঁজতে গিয়ে নয়ন শীলের সেলুনের শার্টার টেনে তাদের আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায়।এ সময় সীমা মন্ডল ও তার পরকীয়া প্রেমিক মিলে গলা টিপে দীপ্তকে হত্যা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মরদেহ সেলুনে বসার জন্য কাঠের তৈরি সিটের ভেতর লুকিয়ে রাখেন।দুই দিন সিটের ভেতর থাকায় লাশটিতে পচন ধরে। এতে বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ২৯ মে রাতে বস্তায় ভরে লাশটি অদূরে একটি ডোবায় ফেলে দেন তারা দুজনসহ সেলুন মালিক দম্পতি।এর আগে গত ২৮ মে দীপ্তর বাবা থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন।দীপ্ত নিখোঁজের ঘটনায় সন্দেহ হওয়ায় এলাকাবাসী নয়ন ও রতনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা দীপ্তকে হত্যার কথা স্বীকার করেন।খবর পেয়ে পুলিশ দীপ্তর লাশ উদ্ধার করে বরিশাল মর্গে পাঠায়।এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে নয়ন ও সেলুন মালিক দম্পত্তিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।তারা নয়ন ও তার পরকীয়া প্রেমিকা সীমার অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলায় শিশুটিকে হত্যা এবং হত্যার পর লাশ লুকাতে সহযোগিতার কথা স্বীকার করেন।
পরে সীমাকেও আটক করে পুলিশ।দীপ্তর বাবা দীপক মণ্ডল বাদী হয়ে ৩১ মে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বুধবার (১ জুন) বিকেলে ৪ জনকে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। আদালতে ৪ জনই দীপ্ত হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। উজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।অপরদিকে অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলায় মেয়ে তন্নি আক্তারকে (১৩) শ্বাসরোধে হত্যা করেন মা ও তার পরকীয়া প্রেমিক। বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের ছোট রাজাপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছে ।এ ঘটনায় ঘাতক মা লিপি আক্তারকে (৩০) আটক করেছে কাউনিয়া থানা পুলিশ।তবে তার পরকীয়া প্রেমিক কবির খান এখনও পলাতক রয়েছেন।আটক লিপি আক্তার (৩০) কাউনিয়া থানাধীন সায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের ছোট রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. সোহরাব হাওলাদারে স্ত্রী। শনিবার (৪ জুন) দুপুরে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) কাউনিয়া থানায় লিখিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান উপ-কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ জাকির হোসেন মজুমদার।তিনি আরও জানান, বরিশাল নগরের কাউনিয়া থানাধীন সায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের ছোট রাজাপুর গ্রামের সোহরাব হাওলাদারের স্ত্রী লিপি আক্তারের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান একই ইউনিয়নের রামকাঠি গ্রামের নুরু খানের ছেলে কবির খান।ঘটনার দিন গত ২৭ মে দুপুরে লিপি আক্তার কবির খানের সঙ্গে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হন। এ সময় মেয়ে তন্নি আক্তার তা দেখে ফেলে এবং বাবাকে বলে দেওয়ার কথা জানায়। তখন মা লিপি আক্তার ও তার পরকীয়া প্রেমিক কবির খান মিলে তন্নিকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তন্নির গলায় দড়ি দিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে রাখেন। এরপর তন্নি আত্মহত্যা করেছে বলে এলাকাবাসীকে জানান লিপি আক্তার।এ ঘটনায় গত ২৭ মে কাউনিয়া থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। পরে মামলার তদন্তে গিয়ে মূল রহস্য উদঘাটন করেন কাউনিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ছগির হোসেন।
উপ-পুলিশ কমিশনার উত্তর মোহাম্মদ জাকির হোসেন মজুমদার আরও জানান, এই ঘটনায় নিহতের বাবা সোহরাব হাওলাদার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন (মামলা নং ৩)। আর হত্যাকারী মা লিপি আক্তারকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতিদিন যেখানে গড়ে প্রায় ১৩ জন অর্থাৎ প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হয় সেখানে নিজ সন্তানের হত্যাকারী হিসেবে সম্পৃক্তার দায়ে মায়ের গ্রেফতার হওয়া সত্যিই উদ্বেগজনক। আসলে আমাদের বর্তমান সমাজটাতে কেন জানি ঘুনে ধরেছে। যেখানে অগনিত মা সন্তানকে বুকে আগলে রেখে ওর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে স্বামীর নির্মম নির্যাতন সহ্য করে বেঁচে থাকেন সেখানে সামান্য কিছু মোহ আর স্বল্প সুখের আশায় গর্ভধারিনী মা কিভাবে সন্তানের হত্যাকারী হয়ে উঠেন যদিও আমরা প্রায়শই দেশের বিভিন্ন স্থানে নবজাতকের মৃতদেহ পড়ে থাকার খবর পাই। এটাকেও একধরনের হত্যা বলা চলে। যে সন্তানকে মা দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেন সেই সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই অপারেশনের মাধ্যমে তাকে মেরে ফেলে ডাস্টবিন আর আর্বজনার মধ্যে ফেলে দেয়াকেও হত্যাকান্ড বলঅ চলে।
মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’-এ শ্বাশত চিরন্তন সত্য বানীটি জেনেই আমরা যারা সন্তান আছি তারা বড় হই। তাই মা কখনো তাঁর সন্তানকে হত্যা করতে পারে তা মেনে নিতে পারিনা। পর পর ঘটে যাওয়া উজিরপুর আর শায়েস্তাবাদে দুটি হত্যাকান্ড জাতি হিসেবে, এক সন্তান হিসেবে আমাকে ব্যথিত লজ্জিত করেছে। পরকীয় বা কোন অনৈতিক সর্ম্পকে জড়ানোর বিষয়ে আমার কোন কথা নেই। এটা যার যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট। কিন্তু অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে মমতাময়ী মা থেকে আপনি ডাইনি হয়ে উঠবেন নিজ সন্তানকে হত্যা করে মা জাতিকে কলংকিত করবেন তা হতে পারেনা। যারা এসকল কাজ করছেন বা এসকল কাজে লিপ্ত রয়েছেন তাদের ভেবে দেখা দরকার যারা আজকে মোহে পড়ে, সামান্য সুখের আশায় নিজ সন্তানকে হত্যা করছেন তারাও কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুখের দেখা পাচ্ছেন না। সৃষ্টিকর্তা কিন্তু কোন অপরাধেরই ক্ষমা করেন না।
লেখক সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন